Saturday, April 18, 2020

প্রবালের কথা

প্রবাল প্রাচীর



ভূমিকা:- সমুদ্র তলদেশে বিরাজমান চুনজাতীয় পদার্থ দ্বারা গঠিত একধরনের অমেরুদণ্ডি সামুদ্রিক প্রাণী যাকে আমরা প্রবাল কীট(coral polyps) নামে জানি। এরা অ্যান্থজোয়া শ্রেনী ভুক্ত হয়। ১৮৪২ সালে চার্লস ডারউইন সর্ব প্রথম "The Structure and Distribution of Coral Reef" নামক বইতে প্রবালের ও তার উৎপত্তি সমন্ধে ধারণা দেন।সাধারণ ক্রান্তীয় অঞ্চলে সমুদ্র তলদেশে এক স্থানে উপনিবেশ গড়ে তোলে।এরা সবুজ, হলুদ,গোলাপি, সাদা রঙের হয়ে থাকে।

সংজ্ঞা:-ক্রান্তীয় অঞ্চলে যখন বিভিন্ন রঙের প্রবাল কীটের মৃত দেহাবশেষ সমুদ্রতলদেশে জমাট বেঁধে অতি দীর্ঘাকার কিংবা বলয় আকৃতি বিশিষ্ট সামুদ্রিক ভূমিরূপ গঠিত হয় তাকে প্রবাল প্রাচীর বলে।



কীভাবে গঠিত হয়?
 ক্রান্তীয় অঞ্চলে অগভীর সমুদ্রে প্রবাল কীটের দেহ থেকে নিঃসৃত এক ধরনের আঠালো পদার্থ ও সমুদ্রের জল থেকে সংগৃহীত ক্যালসিয়াম কার্বনেট বা  চুনজাতীয় পদার্থ মিশে বহিঃ আবরণ তৈরী করে এবং আঠালো পদার্থের কারণে একে অন্যের সঙ্গে আটকে যায়। মৃত্যুর পরও এরা একসাথে সমুদ্র তলদেশে স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়। কালক্রমে স্তূপাকারের নিম্নাংশ প্রচন্ড   চাপে কঠিন রূপ ধারণ করে।একবার প্রবালের মৃত দেহ সঞ্চিত হতে থাকলে তা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়ে কখনও কখনও সমুদ্র তল থেকে উঁচু তে হতে থাকে।

প্রবাল প্রাচীর গঠনের অনুকূল অবস্থা:-
১. সমুদ্র জলের উষ্ণতা:- এরা অধিক উষ্ণতা ও অধিক শীতলতা কোনোটাই সহ্য করতে পারে না।তাই গড় ১৮℃ থেকে ৩০℃ উষ্ণতা প্রবাল প্রাচীর গঠনে অনুকূল।৩০℃ এর বেশি উষ্ণতায় এরা বেড়ে উঠতে পারে না।এইজন্য কীট গুলি সাধারণ ৩০°উত্তর থেকে ৩০°দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে দেখা যায়।
২.সমুদ্র জলের গভীরতা:- যথেষ্ট পরিমাণের সূর্যালোক প্রবাল প্রাচীর গঠনের জন্য প্রয়োজন।সূর্যালোক যেখানে পৌঁছায় না সেখানে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় । তাই সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬০-৭৫ মিটার গভীরতায় প্রবাল প্রাচীর গড়ে তোলার জন্য অনুকূল।
৩.সমুদ্র জলের লবনতা:- ২৭% -৩০% লবনতা প্রবাল প্রাচীরের জন্য অনুকূল কারণ অধিক লবনতা প্রবাল কীটের জন্যে ক্ষতিকারক।
৪.স্বাদু জলের  বা মিষ্টি জলের প্রভাব:- প্রবাল কীট মিষ্টি জলে বেঁচে থাকতে পারে না তাই তারা মোহনায় গড়ে উঠে না । সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে প্রাচীর গড়ে উঠে।
৫. সমুদ্র স্রোত:-
সমুদ্রাস্রোত প্রবাল প্রাচীর গড়ে তোলার পক্ষে উপযুক্ত।কারণ স্রোত বা ঢেউ প্রবাল কীটের খাদ্যের জোগান দেয়।এই জন্য প্রবাল কীট উন্মুক্ত সমুদ্রে বেশী দেখা যায়।
৬.সমুদ্র মঞ্চ:- উন্মুক্ত সমুদ্রে প্রবাল প্রাচীর গঠনের জন্যে সমুদ্রমঞ্চ এর প্রয়োজন কিন্তু তার গভীরতা অবশ্যই ৯০মিটারের মধ্যে হতে হবে।
৭.দূষণ মুক্ত উপকূল:- সমুদ্র উপকূলীয় জল অবশ্যই দূষণমুক্ত হওয়া জরুরি।

প্রবাল প্রাচীরের শ্রেণীবিভাগ

প্রবাল প্রাচীরকে চার্লস ডারউইন উৎপত্তি  ,প্রকৃতি ও আকার অনুসারে তিনভাগে ভাগ করেন
১.প্রান্ত প্রবাল প্রাচীর ( Fringing Reef)
২. প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর ( Barrier Reef)
৩.অ্যাটল (Atoll)

অবস্থান অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১. ক্রান্তীয় অঞ্চলের প্রবাল প্রাচীর
২. প্রান্ত দেশীয় প্রবাল প্রাচীর


১.প্রান্ত দেশীয় প্রবাল প্রাচীর
যেসব প্রবাল প্রাচীর মহিসোপানের ঢালু অংশে বা উপকূলের কাছাকাছি প্রায় সমান্তরালভাবে বা বলয় আকারে অবস্থান করে তাকে প্রান্ত দেশীয় প্রবাল প্রাচীর বলে।





■বৈশিষ্ট :-
◆ এরা সংকীর্ণ প্রকৃতির হয়
◆এদের বিস্তার অপেক্ষাকৃত কম
◆ সমুদ্রামুখী দিকটি অপেক্ষকৃত উঁচু স্থলভাগের তুলনায়।
◆কখনো কখনো এই ধরণের প্রাচীর সংকীর্ণ অগভীর লেগুন দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয় একে বোট চ্যানেল ( boat channel) বলে।
◆যেখানে সমুদ্র তরঙ্গ প্রবালকে সঞ্চয় করে তাকে রিফ ফ্ল্যাট (reef flat) বলে
◆এরা উন্মুক্ত সমুদ্রাভিমুখী বা আবদ্ধ হয়ে থাকে

■উদাহরণ:- দক্ষিণ ফ্লোরিডা প্রবাল প্রাচীর ও সাকাউ দ্বীপের প্রাচীর

■ প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর ( Barrier Reef)
যখন প্রবাল প্রাচীর উপকূল থেকে কিছুটা দূরে অগভীর লেগুন দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যে অনুদৈঘ্য বা বৃত্তাকার প্রবাল প্রাচীর কে প্রতিবন্ধক প্রবাল প্রাচীর ( Barrier Reef) বলে।



■বৈশিষ্ট্য:-
১. সমুদ্র থেকে 60 মিটার গভীরতা থেকে এর বৃদ্ধি ঘটে।
২.সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর এরা কয়েক কিমি বিস্তৃত  থাকে।
৩.এরা অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়
৪.এর সমুদ্রামুখী ঢাল ৪৫° এবং স্থল ভাগের ঢাল ১৫° হয়ে থাকে।

৫.লেগুন গুলির গভীরতা ৪০-৮০মিটার হয়ে থাকে।অনেকসময় প্রাচীর ও উপকূলের মাঝে লেগুনের মধ্যে প্রান্ত প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠে।
■উদাহরণ: অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট বেরিয়ার রিফ যা উত্তর পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৯°-২০° দক্ষিণ অক্ষাংশে ১২০০ মাইল জুড়ে অবস্থিত।

■অ্যাটল(Atoll)
সমুদ্রের অগভীর অংশে স্বল্পোথিত বৃত্তাকার বলয়ের আকারে যেসব খাড়া ঢাল বিশিষ্ট প্রবাল প্রাচীর গড়ে উঠে তাকে অ্যাটল(atoll) বলে


■বৈশিষ্ট্য:-
১.সমুদ্রের জলতলের উত্থান ও পতনের সাথে এদের অবস্থান জড়িত
২.  এদের আকৃতি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার হয়।
৩. এদের মাঝে গভীর লেগুন থাকে যাদের গভীরতা ৩০-৫০মিটার হয়
৪. এর সাথে অনেক সংযোগ কারী চ্যানেল থাকে যার মাধ্যমে জল লেগুন এ প্রবেশ করে।
৫. এরা স্থলভাগ থেকে কয়েকশো কিমি দূরে অবস্থান করে
৬.অনেকসময় প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ কমে দ্বীপ গঠন করে।

■ উদাহরণ:- পূর্ব ফিজি প্রবাল বলয়,ও পশ্চিম ক্যারোলিনা ট্রাঙ্ক বলয়।,প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল বলয়

No comments:

Post a Comment