ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয় চক্র
ভুমিকাঃ- ১৮৯৯ সালে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক William Morris Davis ( ১৮৫০-১৯৩৪) সর্ব প্রথম ক্ষয়চক্রের ধারণা দেন। তাঁর মতে ক্ষয়চক্র হল কোন অঞ্চলে গঠিত ভূমিরূপ সেই অঞ্চলের শিলার গঠন, প্রক্রিয়া ও সময়ের উপর নির্ভরশীল। ( landscape is a function of structure, process and time). ভুমিরূপের বিবর্তন এই ধারনাটি চার্লস ডারউইনের “ the origin of species” এই মডেলকে অনুসরন করে তৈরি। তিনি ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ক্ষয়চক্রের বিকাশ ঘটান।
ধারনাঃ- সাধারণত কোনো ভূমিরূপ ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক অবস্থা থেকে শেষ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায়। তাকে ক্ষয়চক্র বলে। ডেভিসের মতে কোন ভূমিরূপ গঠনের ক্ষেত্রে শিলার গঠন, প্রক্রিয়া এবং সময়ের উপর নির্ভরশীল। এখানে শিলার গঠন বলতে শিলার নতি, আয়াম, কাঠিন্য ,প্রবেশ্যতা , ভাঁজ ও চ্যুতির স্তরায়ন তলকে বোঝায়। প্রক্রিয়া বা process বলতে নগ্নিভবন ও ক্ষয়জাত প্রক্রিয়ার এজেন্ট যেমন নদী, বায়ু , জল , এবং সমুদ্র তরঙ্গ ইত্যাদিকে বোঝায়। এবং সময় বলতে কোন ভূমিরূপ ক্ষয়চক্রের কোন পর্যায় রয়েছে তা নির্দেশ করে। ডেভিস সময়ের সাথে সাথে কতগুলি মডেল উপস্থাপন করেন সেগুলি হলঃ complete cycle of river life in 1899 , geographical cycle in 1899 and slope evolution ইত্যাদি। তিনি স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের সংজ্ঞাস্বরূপ বলেছেন যে নিদিষ্ট ক্রমানুসারে কোন নিদিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন উত্থিত ভূমিরূপ ক্ষয়ের যখন ক্ষয়ের শেষ পর্যায় পৌঁছায় তাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে।
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের শর্তাবলিঃ
ডেভিস ক্ষয়চক্রের বর্ননা করতে গিয়ে কতগুলি শর্তের কথা বলেছেনঃ
 ভূমিভাগ সর্বদা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরে অবস্থান করবে।
 ভুমিভাগের উত্থানকালে ক্ষয়কাজ সম্পন্ন হবে না।
 কোঠিন ও কোমল শিলা পর পর অবস্থান করবে।
 অঞ্চলটি আর্দ্র জলবায়ুর অন্তর্গত হতে হবে।
 ভূমিরূপের বিবর্তন একটি নিদিষ্ট পর্যায়ের মাধ্যমে হতে থাকে।
 নদীক্ষয় , বায়ু ক্ষয় , আববিকার, এবং নগ্নিভবন প্রভৃতি বহিঃজাত প্রক্রিয়া গুলি ভূমির পরিবর্তনে সাহায্য করে।
 নদী তার নিম্নক্ষয়ের শেষ সীমানায় সমভূমিতে পরিনত হবে।
ক্ষয়চক্রের ব্যাখাঃ
ভূমি ভাগের উত্থানের পর নদী যখন ক্ষয়কাজ শুরু করে তখন সে তিনটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্ষয় কাজ সম্পন্ন করে। এই তিনটি প্রক্রিয়া হল
১. যৌবন অবস্থা ( youth stage)
২. পরিণত অবস্থা ( Mature stage)
৩. বার্ধক্য অবস্থা ( Old stage)
যৌবন অবস্থা ( youth stage):
ভূমিরূপের উত্থান ঠিক শেষ হওয়ার পর থেকে নদী ক্ষয় করতে শুরু করে। এটি একদম প্রাথমিক পর্যায় । এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট হলঃ
 ভূমির উচ্চতা বেশী হওয়ার ফলে নদী দ্রুত নিম্ন ক্ষয় করে V ও I আকৃতি ভূমিরূপ গঠন করে ।
 ভূমির ঢাল বরাবর অনুগামী নদীর ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীর সৃষ্টি করে বৃক্ষ রূপি জলনির্গমন প্রণালী রূপে অবস্থান করে।
 জলবিভাজিকা প্রশস্ত হওয়ার জন্যে এখানে হ্রদ ও জলাভুমির সৃষ্টি হয়।
 কঠিন ও কোমল শিলা পর্যায়ক্রমিক ভাবে অবস্থান করায় কোমল শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নদী বরাবর জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
 যৌবনকালে অবঘর্ষ প্রক্রিয়ার দ্বারা মন্থকুপ তৈরি হয় ফলে দ্রুত নদীখাত ক্ষয় করে।
 পার্শ ক্ষয় অপেক্ষা নিম্ন ক্ষয় বেশী হওয়ার জন্যে শৈলশিরার শির্ষদেশে ও উপত্যকার তলদেশের আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। উপত্যকার ঢাল ও বেশী থাকে।
 পরিণত অবস্থাঃ( Mature stage)
যৌবন অবস্থার সব চিহ্ন শেষ হওয়ার পর শুরু হয় পরিণত অবস্থা।এই অবস্থার বৈশিষ্ট হলঃ
 জলবিভাজিকাতে সৃষ্ট হ্রদ ও জলাভূমির এই পর্যায়ে বিলুপ্তি ঘটে।
 মস্তকক্ষয়ের মাধ্যমে নদী উপত্যকা বিস্তার হয় এবং জলবিন্যাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
 এই পর্যায়ে ভূমির আপেক্ষিক উচ্চতা বেশী হয় প্রথম দিকে।
 নিম্ন ক্ষয়ের পাশাপাশি পার্শব ক্ষয় হয় ফলে নদীর দুই ধারে প্লাবনভুমি গড়ে ওঠে।
 প্রধান নদীর অনুদৈর্ঘ্য ঢাল ভারসাম্য স্তরে পৌঁছায় ( profile of equilibrium)
 পরিণত অবস্থার শেষে নদী পার্শ ক্ষয় বেশী করে।
 বার্ধক্য অবস্থাঃ
 এটি শেষ অবস্থা যেখানে নদী নিম্নক্ষয় বন্ধ করে দেয় শুধু পার্শ ক্ষয় হয়।
 নিম্নক্ষয় বন্ধ হওয়ায় আপেক্ষিক উচ্চতা হ্রাস পায়।
 উপত্যকাগুলি চওড়া ও কম ঢালযুক্ত হয়।
 প্লাবনভুমির উপর দিয়ে নদী সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয় এবং অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ গঠন করে ।
 এক্ষেত্রে অবহবিকার ও নগ্নিভবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 জলবিভাজিকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়ের প্রতিরোধকারী শিলা দ্বারা গঠিত স্বল্প উচ্চতাযুক্ত পাহাড়কে মোনাডোনাক বলে।
 ক্ষয়ের শেষসীমানায় বৈচিত্র্যহীন সমপ্রায়ভূমিতে ( peneplain) পরিণত হয়।
 ঝাড়খণ্ডের গালুদিতে পাট মাহুলিয়া মোনাডনাকের একটি উদাহরন।
সমালোচনা:-
★ডেভিসের মতানুসারে ভূমির উত্থান কাজ শেষ হওয়ার পর ক্ষয়চক্রের প্রক্রিয়া শুরু হবে যা বাস্তবিক নয়।
★ ডেভিসের মতানুসারে ক্ষয়চক্র আদৌ শেষ হতে পারে কিনা সন্দেহ কারণ ক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছাবার আগেই ভূমির উত্থান ঘটলে ক্ষয় চক্র ব্যাহত হয়।
★ ভূমির দ্রুত উত্থানের কথা বলেছেন কিন্তু পাত সংস্থান একটি ধীর সম্পন্ন।
★ ডেভিস সময় কে গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু পেঁঙ্ক দেননি।
উপসংহার
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের সমালোচনা হলেও এটি প্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে উপস্থাপিত ধারণা।তিনি সরল ও সহজ ভাষায় উপস্থাপিত করেছিলেন।বর্তমানে ভূতাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ন।



No comments:
Post a Comment